আগামী ৪৮ ঘণ্টায় যুক্তরাষ্ট্রকে দুটি চিঠি দেবে বাংলাদেশ

Published By Ridoykhan (ছোট মিয়া) | 07 April 2025, 01:47 AM

Article Image
আগামী ৪৮ ঘণ্টায় যুক্তরাষ্ট্রকে দুটি চিঠি দেবে বাংলাদেশ । ছবি: আগামী ৪৮ ঘণ্টায় যুক্তরাষ্ট্রকে দুটি চিঠি দেবে বাংলাদেশ
Copyright Receive By: ridoykhan@worldwidezia.com

রপ্তানি পণ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি ও বাণিজ্য ব্যবস্থায় বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে, যার বাইরে নয় বাংলাদেশও। এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে বৃহস্পতিবার থেকে প্রতিদিন উচ্চপর্যায়ের একাধিক বৈঠক হয়েছে। গতকাল রোববারও পর্যালোচনা বৈঠক হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। আগের দিন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এ বিষয়ে জরুরি বৈঠক ডেকেছিলেন।

পরিস্থিতি সামলাতে সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গতকাল বিকেলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে দুটি চিঠি দেবে সরকার। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস একটি চিঠি দেবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন আরেকটি চিঠি দেবেন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তর ইউএসটিআরকে।

যুক্তরাষ্ট্রকে যে দুটি চিঠি দেওয়া হবে তাতে কী থাকবে, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব বলেন, বৈঠকে উপস্থিত সবাই মতামত দিয়েছেন। বাংলাদেশ কী কী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করছে, চিঠিতে সেগুলোর উল্লেখ থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধির সঙ্গে প্রতিনিয়তই কথা হচ্ছে। চিঠি হবে ব্যবসাবান্ধব। সেখানে বাংলাদেশের ব্যবসার স্বার্থকে দেখা হবে, যাতে দুই দেশ সমানভাবে লাভবান হতে পারে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে বাংলাদেশের রপ্তানি আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে বৈঠক শেষে ব্রিফ করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি সাংবাদিকদের সামনে চারটি বিষয় তুলে ধরেন। বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুধু পণ্য নয়, সেবা আমদানিও বাড়ানো হবে। দূর করা হবে দেশটির সঙ্গে সব ধরনের অশুল্ক বাধা। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের সক্ষমতা অন্য প্রতিযোগী দেশের তুলনায় এমনভাবে বাড়ানো হবে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ মনে করে বাংলাদেশের পণ্য অন্য দেশের তুলনায় ভালো। এ ছাড়া ব্যবসা সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে উভয় দেশের।

বৈঠকে চারজন উপদেষ্টা, চারজন ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সংকট ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি-সংক্রান্ত হাইরিপ্রেজেনটেটিভ, ১০ সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যানসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ব্রিফিংয়ে বলেন, শুল্ক আরোপের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে পদক্ষেপ নিয়েছে, চীনসহ বড় অর্থনৈতিক শক্তির দেশগুলোও পাল্টা পদক্ষেপ নিচ্ছে। তাতে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটা জানা নেই।

বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক যেন রক্ষা পায়, সেই চেষ্টা করা হবে। পোশাক খাতে শ্রমিকের মজুরি সর্বনিম্ন জায়গায় আছে। এর থেকে কমানো যাবে না। শ্রমিকের দিক থেকে খরচ না কমিয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। দূর করতে হবে অশুল্ক বাধা।

প্রধান উপদেষ্টার হাইরিপ্রেজেনটেটিভ খলিলুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে শনিবার তাঁর কথা হয়েছে। রাষ্ট্রদূত যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ অফিসে কথা বলেছেন। সেখান থেকে যে সংকেত পাওয়া গেছে, তাতে বাংলাদেশের চিন্তাধারার সঙ্গে তাদের সাযুজ্য রয়েছে। আগামী এক-দুই দিনের মধ্যে করণীয়গুলো চূড়ান্ত করা যাবে।

অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপের পর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তাতে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ে স্বস্তি এসেছে। বোঝা যাচ্ছে, সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে নির্ধারিত সময়ে পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশ পিছিয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে বাংলাদেশ আর কী কী জিনিস কিনতে পারে, সে বিষয়ে নজর দেওয়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্য পোশাক খাতের বাইরে নতুন অনেক দুনিয়া আছে। রপ্তানি বাড়াতে সেসব পণ্য খুঁজে বের করতে হবে।

পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত তিন মাস স্থগিত করার অনুরোধ জানাতে আমরা সরকারকে জানিয়েছি। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াও শুল্ক আরোপ তিন মাস স্থগিতের অনুরোধ জানিয়েছে। তিন মাস স্থগিতের কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের যেসব পণ্য এরই মধ্যে আদেশ হয়েছে, পণ্য জাহাজীকরণ (শিপমেন্ট) হয়েছে, সেসব পণ্যের ক্ষেত্রে কী হবে? তা ছাড়া যেসব পণ্য এখনো আমাদের হাতে রয়েছে, সেসব পণ্যের কী হবে? এসব নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে।’

পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেছি। বলেছি, অশুল্ক বাধা দূর করার ব্যবস্থা নিন। সরকারি দপ্তরে বিনিয়োগ-সংক্রান্ত সেবা পেতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সময় বেশি লাগে। এসব সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করুন।’

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, সরকার যে চিঠি দেবে, তাতে ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত তিন মাস স্থগিতের অনুরোধ করতে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়। ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ৯ এপ্রিল থেকে পাল্টা শুল্ক কার্যকর হবে। এর আগেই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে চিঠি পাঠাতে হবে।

ট্রাম্প প্রশাসনের পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘটনাকে ‘হাইপার ডাইনামিক স্টোরি’ বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা স্থগিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

গতকাল সকালে ঢাকার গুলশানে মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের সঙ্গে তাঁর বাসভবনে অনুষ্ঠিত ‘ব্রেকফাস্ট অন ট্রেড ব্যারিয়ার্স’ শীর্ষক বৈঠক করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। বৈঠক শেষে তিনি সচিবালয়ে কয়েকজন সাংবাদিকের কাছে এমন মন্তব্য করেন। বৈঠকে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, প্রধান উপদেষ্টার হাইরিপ্রেজেনটেটিভ খলিলুর রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক কেমন হলো, এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘ভালো হয়েছে। আমরা একটা ধারণা পেয়েছি যে আমাদের মতো অর্থনীতির দেশ, পাল্টা শুল্ক আরোপের কারণে তারা কী অনুসরণ করছে এবং আমরা কী পদক্ষেপ নিতে পারি।’

মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স কিছু বলেছেন কি না জানতে চাইলে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, তারা তো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলবে না। আলোচনা হয়েছে, কিছু দিকনির্দেশনা পাওয়া গেছে। এর মধ্য থেকে কী প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া যায়, তা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে।

বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘যোগাযোগের পদ্ধতিগুলো কী, আকাঙ্ক্ষাগুলো কী, শুল্ক ও অশুল্ক বাধাগুলো কী এবং ব্যবসা করতে গিয়ে যেসব জায়গায় তাদের সমস্যা হচ্ছে, বৈঠক থেকে সেগুলো বোঝার চেষ্টা করেছি। আমাদের অর্থনীতির জন্য যেগুলো সহায়ক, সেগুলো তো আমরা করতেই চাই। তবে যেগুলো সহায়ক নয়, সেগুলো করা সম্ভব নয়, এ রকম একটা আলোচনা করেছি।’

শুল্ক আরোপ কার্যকরের তারিখ যদি ৯ এপ্রিল হয়, তাহলে তো যা করার এর মধ্যেই করতে হবে, এ বিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘না। ৯ তারিখের কথাটাও বোঝার চেষ্টা করেছি যে স্থগিতের কোনো সম্ভাবনা বৈশ্বিকভাবে আছে কি না। তাদের কথা হচ্ছে এ ধরনের কোনো সম্ভাবনা নেই।’

শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা ধারণা ঘুরে বেড়াচ্ছে যে ৯ এপ্রিল কোনো কোনো দেশের জন্য স্থগিতাদেশ আসবে। আমরা এ ধরনের কোনো ধারণা পাইনি। ব্যাপারটা হচ্ছে যে এটা একটা হাইপার ডাইনামিক স্টোরি এবং বিশ্ব বাণিজ্যে এর প্রভাব পড়েছে। দেখা যাক, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মহাপরিচালকও এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছেন।’

বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান গতকাল সকালে অনলাইন বৈঠক করেন ব্যবসায়ী ও গবেষকদের সঙ্গে। এতে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান, বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান, গবেষণা সংস্থা র‍্যাপিডের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক, পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ অংশ নেন।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ব্যবসায়ীরা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি সহজ করতে বাংলাদেশে দেশটির রপ্তানিকারকদের জন্য সেন্ট্রাল ওয়্যারহাউস সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। তা না হলে ব্যবসায়ী পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি বাড়বে না। বর্তমানে শূন্য শুল্কে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি করা যায়। তা সত্ত্বেও দেশের তুলা আমদানির বড় অংশই আসে চীন ও ভারত থেকে। কারণ, এই দুটি দেশ থেকে ব্যবসায়ীদের তুলা আমদানি সহজ। তাই যুক্তরাষ্ট্রের তুলা আমদানি বাড়াতে হলে দেশটিকে সরবরাহ সুবিধা দিতে হবে।

ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত তিন মাস স্থগিতের অনুরোধ জানিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত ট্রাম্প প্রশাসনকে অনুরোধ জানানোর সুপারিশ করেন তাঁরা। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, ব্যবসায়ী ও গবেষকেরা বলেছেন, ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের বিষয়টিকে শুধু অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে হবে না। এটি রাজনৈতিক বিষয়ও।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের শুল্ক-করভার তড়িঘড়ি কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত না নেওয়ারও সুপারিশ করেন একজন গবেষক। তাঁর মতে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্র কী চায়, তা ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে। হুট করে শুল্ক কমিয়ে দিলে কোনো লাভ হবে না।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, একাধিক ব্যবসায়ী বলেছেন, ৯ এপ্রিলের আগে ক্রয়াদেশ দেওয়া পণ্যের মধ্যে যেগুলো এখন বাংলাদেশে উৎপাদন পর্যায়ে রয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে পাল্টা শুল্ক কার্যকর হবে কি না, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে রপ্তানিকারকদের মধ্যে। তাই এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে পুরো বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।